মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ ভাষণ যা মুসলিম সম্প্রদায়ের দায়িত্ব কর্তব্য ও দিকনির্দেশনা যা গোটা মানবজাতির কল্যাণ ও ঐক্য, অগ্রযাত্রা, শান্তি ,মুক্তি ।
মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ, ভাষণ
নবী-রাসুলগণ সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের বাণীর দাওয়াত দিয়েছেন অহিংস পন্থায়। প্রিয় নবীজিও এর ব্যতিক্রম নন। তারপরও অসুরশক্তি প্রীতির কথায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়, শান্তির বাণীতে অশান্তি সৃষ্টি করে। তিন বছর ধরে আল্লাহর হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ‘শিআবু আবিতালেব’ নামক কারাগারে বন্দী করে রাখে। দাওয়াতি কাজে তায়েফ গমন করলে নির্মম নির্যাতনে জর্জরিত করে।
মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে নগরে প্রবেশে বাধা দেয়। ‘দারুন নাদওয়া’য় বুড়ো শয়তানের পরামর্শে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। সব চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) প্রিয় জন্মভূমি মক্কা শরিফ ছেড়ে হিজরত করে মদিনা শরিফে চলে যান। তখন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন বছর। মদিনাবাসীরা যে আশায় মুহাম্মদ (সা.)-কে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়, হিজরত করার পর তা পূরণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। এ লক্ষ্যে তিনি মদিনার পৌত্তলিক ও ইহুদি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ৪৭টি ধারা সংবলিত একটি সনদ প্রণয়ন করেন। তদানুসারে মদিনায় বসবাসরত ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের মধ্য এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এটি ইতিহাস বিখ্যাত প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদ’ (Charter of Medina) নামে পরিচিত।মূলত ইসলামী গণতন্ত্রের অন্যতম প্রতিচ্ছবি হচ্ছে মদিনা সনদ। এই মদিনা সনদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. এ কে এম ইয়াকুব হোসাইন তাঁর ‘ইসলামের ইতিহাস’ বইতে বলেছেন, ‘আরবে এই সনদের (মদিনা সনদ) দ্বারা সর্বপ্রথম ইসলামী গণতন্ত্রের বীজ বপন করা হলো।’ (পৃষ্ঠা : ২২৫) অর্থাৎ এই রাষ্ট্র হচ্ছে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মদিনা সনদের ফলে মদিনায় গৃহযুদ্ধ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান হয়। এই সনদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মদিনায় বসবাসকারী সব অধিবাসীকে সমানাধিকার প্রদান করে। এটা মদিনার মুসলমান ও অমুলমানদের মধ্যে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলে।
মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্যোগে মদিনার পৌত্তলিক, ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিশ্ববিখ্যাত মদিনা সনদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্যার উইলিয়াম মুর তাঁর রচিত ‘The life of Muhammad’ বইতে বলেন, ‘It (Charter) reveals the Man in his real greatness-a master-mind, not only of his own age, but of all ages.Ó-W.Muir, The Life of Muhammad. [এটি (সনদ) মানুষটির সত্যিকার মহত্ত্ব ও অসাধারণ মননশীলতা, যা শুধু তৎকালীন যুগের জন্য নয়, বরং সর্বযুগের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে।]
সূরা সাবা (২৮) আল্লাহ বলেন, আমি তো তোমাকে(নবীজি) সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে
না। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস, তখন তারা বলে, “আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যেটাতে পেয়েছি সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কিছুই জানত না এবং সৎপথপ্রাপ্তও ছিল না, তবুও কি? (সুরা মায়েদা ১০৪), আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আপনার ওপর কিতাব (কুরআন) ও হিকমাহ নাজিল করেছেন’ (সুরা নিসা : ১১৩)। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে, ‘রাসুল (সা.) তোমাদের জন্য যা এনেছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও।’ (সুরা হাশর : ৭) ; সূরা আল ইমরান ৩:৬৪, বল, ‘হে আহলে কিতাব! এমন এক কথার দিকে আসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, তা এই যে, আমরা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ‘ইবাদাত করব না এবং কোন কিছুকে তাঁর শরীক করব না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা এ বিষয়ে সাক্ষী থাক যে, আমরা আত্মসমর্পণকারী। সূরা আল মায়েদা(৬৮) বল, ‘হে ঐশীগ্রন্থধারিগণ! তওরাত, ইঞ্জীল ও যা(কুরআন) তোমার প্রতিপলাকের নিকট হতে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে, তোমরা তা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমাদের কোন ভিত্তি নেই।’ তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা তাদের অনেকের(কাফের) ধর্মদ্রোহিতা ও অবিশ্বাসই বৃদ্ধি করবে। সুতরাং তুমি অবিশ্বাসী(কাফের) সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না। অথাৎ এভাবে পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহর পাশাপাশি ছাড় দিয়েও আল্লাহর অনুমতিতে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণ আয়ত্তকরণের আওতায় আরো শিথিল ও সহজ, স্বল্প বিধান পদ্ধতিসমূহও পৌঁছে দিয়েছেন যাতে শতভাগ বিশ্ব জনগোষ্ঠী ইসলামের শান্তির বাণীর আওতায় আসতে পারে, যেমনঃ নবীজির প্রশিক্ষিত এবাদতসমূহ বা আংশিক চর্চা করেও অনেকে সরাসরি মুসা ও ঈসা বা অন্যান্য নবীদের পূর্বের ইসলামের কিতাবের কিছু শিক্ষা চর্চা করতো যা নফল ইবাদত হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যা মূলত কুরআন, তাওরাত -ইঞ্জিল একত্রে চর্চা বুঝায় অথাৎ যা শিরক কুফর ও অইসলামিক মানদন্ড নয় যেমন মুসা ঈসা(আঃ ) জন্য রোজা রাখা, দরূদ পড়া ,জন্মদিনে স্মরণ করা , দাউদ সুলাইমানের মতো ন্যায়বিচার ও জিকির গাজাল গীত ও জুলকলের মতো পড়াশুনা , ইত্যাদি আর জান্নাত মূলত অর্জিত হবে যার পরিমাণে সওয়াব বেশি ও পাপ কম। অন্য আয়াতে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হয়েছিলে; যদি তুমি কঠোরচিত্ত হতে তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা চাও এবং কাজেকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো এবং তুমি কোনো সংকল্প গ্রহণ করলে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্ভরশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯); আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুল (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। এ কথা তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ (সুরা আহযাব : ২১)। সূরাঃ (৫৬) আল-আহযাব, নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তার ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোআ-ইসতেগফার করেন।(১) হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত(২) পাঠ কর এবং তাকে যথাযথ ভাবে সালাম(৩) জানাও। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনিই শাফা'আত করবেন। সকল নবীদের জন্য প্রশংসা দুরুদ সূরা আছ ছাফ্ফাত ( আয়াত নং - ১৮০ -১৮২) তোমার প্রভু - সম্মান ও ক্ষমতার মালিক - তারা যা দাবি করে তার চেয়েও পবিত্র! রাসূলগণের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সকল জগতের প্রতিপালক।
অন্যদিকে, নবীদের বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও ভেদাভেদ নেই আয়াত সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:১০৫ আয়াতঃ
অর্থঃআমি সত্যসহ এ কোরআন নাযিল করেছি এবং সত্য সহ এটা নাযিল হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদাতা ও ভয়প্রদর্শক করেই প্রেরণ করেছি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাসুল, তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছেন এবং মুমিনরাও। তাদের সবাই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবগুলো এবং তাঁর রাসুলদের প্রতি ঈমান এনেছে। তারা বলে, আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।’ (সুরা বাকারা: ২৮৫), সূরা হা-মীম সেজদাহ ৪১:৪৩ অর্থঃআপনাকে(নবীজি মুহাম্মদ সাঃ) তো তাই বলা হয়, যা বলা হত পূর্ববর্তী রসূলগনকে। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এই রাসুলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা বাকারা: ২৫৩)
অন্য আয়াতে পাঁচজন নবীর বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন আমি নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নুহ, ইবরাহিম, মুসা ও মারিয়মপুত্র ঈসার কাছ থেকেও—তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।’ (সুরা আহজাব: ৭); সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (স.): আমাদের প্রিয়নবী (স.) ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসুল। আল্লাহ তাঁকে সব নবী-রাসুলসহ পৃথিবীর সকল মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি আদম-সন্তানদের ইমাম (নেতা) হব, এতে অহংকার নেই। আল্লাহর প্রশংসার পতাকা আমার হাতেই থাকবে, এতেও গর্ব নেই। সেদিন আল্লাহর নবী আদম (আ.) এবং নবীদের সবাই আমার পতাকার নিচে থাকবেন। সর্বপ্রথম আমার জন্য মাটিকে বিদীর্ণ করা হবে, এতে কোনো অহংকার নেই।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৫)
আর সূরা বাকারা ১০৬ আল্লাহ বলেন,আমি কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা ভুলিয়ে দিলে, তাত্থেকে উত্তম কিংবা তারই মত আয়াত নিয়ে আসি, তুমি কি জান না যে, আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। তুমি কি জান না যে, আকাশমন্ডলী ও ভূমন্ডলের রাজত্ব সেই আল্লাহরই এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনও অভিভাবক নেই এবং সাহায্যকারীও নেই। সূরা ফুরকান ১ পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবর্তীণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়। আল্লাহ থেকে গোটা মানবজাতির সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ দ্বীন বিধান কুরআন ও সুন্নাহ এমনভাবে প্রণয়ন হয়েছে যা অতীতের সকল নবীরাসূল আদম থেকে ঈসা আঃ পর্যন্ত সকলের প্রশিক্ষণ সরাসরি সংযুক্ত হয়েছে, সংস্কার হয়েছে, নতুনত্ব দিয়ে উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে যা চর্চা যুগোপযুগী ও পরিপক্ক যা বেশি সওয়াব । অথাৎ নবী মুহাম্মদ সাঃ বিধিবিধান চর্চা করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতীতের সকল নবী রাসূলের অনুসারী ও দলভুক্ত হয়ে যাওয়া হয়। অথাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, ইহুদি, খ্রিস্টান, শিয়া, সুন্নি, হানাফী, আহলে হাদিস, ফ্লোক , ইত্যাদি নানা গোত্রীয় দলীয় পরিচয়ে চললেও গোটা মানবজাতিকেই আখিরাতের জান্নাতের সওয়াব অর্জনের জন্য কুরআন সুন্নাহর নির্দেশিত ইবাদতসমূহ ও পদ্ধতিই চর্চা করতে হবে এবং তা বাইবেল, তাওরাত, বেদ গীতা, তালমুত, ত্রিপিটক , কিতাব, হাদিস, হলি বুক , ডিভাইন বুক, বই, স্যালভেশন বুক, ইত্যাদি যে নামেই হোক না কেন। বর্তমানে পৃথিবীতে চার থেকে দশ হাজার ধর্মীয় পরিচয়ের দলীয় গোত্র বিদ্যমান যা সকলকেই কুরআন সুন্নাহ চর্চা করতে হবে । সূরা আল ইমরান ১১০, তোমরাই(ইসলামের কুরআন সুন্নাহর মানদণ্ড মান্যকারী) শ্রেষ্ঠ উম্মত [১], মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে [২] এবং আল্লাহ্র উপর ঈমান আনবে [৩]। আর আহলে কিতাবগণ যদি ঈমান আনতো তবে তা ছিল তাদের জন্য ভাল। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুমিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসেক(ইসলামের মানদণ্ড লঙ্ঘনকারী)।
সূরা আল ইমরান (৯৫) বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে অংশীবাদীদের দলভুক্ত ছিল না।
(১০০) হে বিশ্বাসিগণ(মুমিনগণ)! যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তোমরা যদি তাদের দলবিশেষের আনুগত্য কর, তাহলে তারা তোমাদেরকে ঈমানের (বিশ্বাসের) পর আবার অবিশ্বাসী (কাফেরে) পরিণত করে ছাড়বে অথাৎ অতীতের কিতাবগুলো আংশিক ও অসম্পূর্ণ । (৯৯) বল, ‘হে ঐশীগ্রন্থধারিগণ! তোমরা বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর পথে বাধা দান করছ কেন? তোমরা তার বক্রতা অন্বেষণ করছ; অথচ তোমরাই (এ বিষয়ে) সাক্ষী।[1] আর আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্বন্ধে উদাসীন নন।’ ১০১. আর কিভাবে তোমরা কুফরী করবে অথচ আল্লাহর আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে তিলাওয়াত করা হয় এবং তোমাদের মধ্যে তার রাসূল রয়েছেন?(১) আর কেউ আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করলে সে অবশ্যই সরল পথের হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। ১০২. হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া(ধার্মিকতা: ইবাদত সমূহ ও দিকনির্দেশনা) অবলম্বন কর(১) এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।
কুরআন মাজীদ আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এটি সত্য-মিথ্যার পার্থক্যনিরূপক মানদন্ড ও হেদায়েতের আলোকবর্তিকা। মহান আল্লাহ বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا ‘মহা পবিত্র তিনি যিনি স্বীয় বান্দার প্রতি ফায়ছালাকারী গ্রন্থ নাযিল করেছেন পর্যায়ক্রমে। যাতে সে জগদ্বাসীর জন্য সতর্ককারী হ’তে পারে’ (ফুরক্বান ২৫/১)। তিনি আরো বলেন, قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ ‘বস্তুত: তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে এসেছে একটি জ্যোতি ও স্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাব’ (মায়েদাহ ৫/১৫)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ ‘আলিফ লাম র-। এই কিতাব আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে বের করে আনতে পার অন্ধকার হ’তে আলোর পথে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। মহা পরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর পথে’ (ইবরাহীম ১৪/১)। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের সকল কিছুই এতে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ‘এই কিতাবে কোন কিছুই আমরা বলতে ছাড়িনি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। তিনি আরো বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ ‘আর আমরা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি সকল কিছুর বিশদ ব্যাখ্যা, পথনির্দেশ, অনুগ্রহ এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে’ (নাহল ১৬/৮৯)। সুতরাং কুরআন মাজীদ আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য উপহার। যা মুসলিম উম্মাহর গর্বের প্রতীক। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَكَ وَلِقَوْمِكَ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ ‘আর এই কুরআন তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্য মর্যাদার প্রতীক এবং তোমরা সত্বর এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে’ (যুখরুখ ৪৩/৪৪)। রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ বলতে বোঝায়, আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সা.) যেসব কাজ করেছেন, করতে নির্দেশ দিয়েছেন বা কেউ করলে তিনি সম্মতি দিয়েছেন-সেসব কাজ করা আর তারাই মুসলিম ও আত্মসমর্পণকারী । রাসুল (সা.) জুমার খুতবায় ঘোষণা করেছেন, ‘উত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব আর উত্তম পথ হলো মুহাম্মাদ (সা.)-এর পথ’ (মুসলিম : ৮৬৭)। অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার সুন্নত ও আমার পরে হেদায়েতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নতের অনুসরণ করো, এগুলো শক্ত করে আঁকড়ে ধরো।’ (আবু দাউদ : ৪৬০৭)। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিক বা না দিক, যারা এক আল্লাহ ইবাদতে ঈমান আনে, কিবলা বিশ্বাস করে, নামাজ পড়ে ও কুরবানী মাংস খায় ও বিশ্বাস করে, এরাই মুসলিম (সহীহ হাদিস)। সর্বশেষ ও চূড়ান্ত পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহ বলতে বুঝায়, ফরজে আইন ও কিফায়া দায়িত্ব: ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ, হালাল হারাম, ঈদ কুরবানী, জুমা, আকিকা, খৎনাহ, বিবাহ, কুরআন শিক্ষা ও প্রচার করা, দান, দাফন কাফন, সৃষ্টির সেবা, পরিবার আত্মীয় ও প্রতিবেশীর হক, ফরজ, সুন্নাহ, ওয়াজিব ও নফল ইবাদতসমূহ চর্চা করে সৎকর্মশীল জীবনাচার অতিবাহিত করা , সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা যা পরিপূর্ণ মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত হয় । পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহ চর্চায় দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায় আর দুর্বল মানদন্ড কুরআন সুন্নাহ ও তাওরাত-ইঞ্জিল সামঞ্জস্যতা স্বল্প বিধান চর্চায় সওয়াব কম। ‘আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে এবং নেক আমল করবে আমি তাকে দু’বার তার প্রতিদান দেব এবং আমি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছি সম্মানজনক জীবিকা।’ (সুরা আহযাব: আয়াত ৩১); সূরা আয-যুমার ৫৩, বল- হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ(বিশুদ্ধ ইবাদতহীনতা), তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন(অনুতপ্ত হলে)। তিনি অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। আল্লাহ হয়তো তাদের ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০২), আপনি আমার বান্দাদের বলে দিন, আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল পরম দয়ালু (সুরা-১৫ হিজর, আয়াত: ৪৯)। মুসা আ. অনুতপ্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘মুসা বলল, এটা শয়তানের কাণ্ড। সে তো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তকারী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি অবিচার করেছি। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সূরা কাসাস, আয়াত : ১৫-১৬); যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্যে আছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নির্ঝরিণীসমূহ। এটাই মহাসাফল্য। [সূরা বুরুজ: 11], সূরা আল হজ ২৩. নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তাদেরকে অলংকৃত করা হবে সোনার কাঁকন ও মুক্তা দ্বারা(১) এবং সেখানে তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ হবে রেশমের।(২)
উম্মতের প্রতি প্রিয় নবির ভালোবাসা পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। আর প্রিয়নবি (সা.) গুনাহগার উম্মতকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। উম্মতের(পরামর্শ গ্রহণকারী ও চর্চাকারীগণ ) জন্য তিনি এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, মহান আল্লাহর দরবারে তাদের মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন সমবেত সাহাবিদের সামনে আল্লাহ পাকের একটি বাণী পাঠ করলেন, যাতে নিজ উম্মত সম্পর্কে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ বক্তব্য উল্লেখ আছে : ‘হে আমার পরওয়ারদিগার! এ মূর্তিগুলো অসংখ্য মানুষকে বিপথগামী করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ(পরামর্শ গ্রহণকারী ও চর্চাকারীগণ ) করবে কেবলমাত্র সে-ই আমার দলভুক্ত। আর কেউ আমার কথা অমান্য করলে তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৬)। কাফেরদের জন্য নবীজির দোয়া হে আল্লাহ, তাদের ক্ষমা করো, জ্ঞান দাও, হেদায়েত কর। তারপর নিজ উম্মত সম্পর্কে হজরত ঈসা (আ.)-এর এ বক্তব্য কুরআন থেকে পাঠ করলেন : ‘যদি তুমি তাদের শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করে দাও তবে তা-ও তোমার অসাধ্য নয়। কারণ, তুমি তো মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। (সূরা মায়েদা : ১১৮)। এ দুটি আয়াত পাঠ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর দরবারে দুটি হাত উত্তোলন করে বললেন-‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত! তাদের ক্ষমা কর এবং অনেক কান্নাকাটি করলেন।’ তখন মহান আল্লাহ জিবরাইলকে বললেন, হে জিবরাইল! মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যাও। তাঁকে জিজ্ঞেস কর, সে কী কারণে কাঁদছে? অথচ আল্লাহপাকই সর্বাধিক জানেন, তিনি কেন কাঁদছেন। জিবরাইল (আ.) এসে তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। নবি (সা.) তাকে সব কিছু জানালেন। অথচ আল্লাহ নিজেই সব কিছু জানেন। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে ফিরে যাও। গিয়ে তাঁকে বল, আমি অচিরেই তোমাকে তোমার উম্মতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট করব। তোমার মনে ব্যথা দেব না।’ (সহিহ মুসলিম : ২০২)। উম্মতের প্রতি প্রিয়নবি (সা.)-এর ভালোবাসা পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। যে কারণে আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন এভাবে ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসূল এসেছেন; (তোমাদের জন্য তাঁর মায়া এতই বেশি যে) তোমাদের যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার কাছে খুবই কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা : ১২৮)। অথাৎ পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহ বিশ্বাস করে যতদূর সম্ভব চর্চা করা।
দ্বিতীয় হিজরি সন তথা হিজরতের দ্বিতীয় বছর রমজান মাসের ১৭ তারিখ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ বছরই প্রথম উভয় ঈদের প্রবর্তন ও সূচনা হয়। বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর পয়লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করা হয়। এই বছরই মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনু কাইনুকা সম্প্রদায়কে পরাস্ত করার পর ১০ জিলহজ প্রথম ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ) পালন করা হয়।
ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশে মক্কা যাত্রা করলেন। কুরাইশরা বাধা দিলে হজরত (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। এখানেই হজরত উসমান (রা.)-এর মধ্যস্থতায় মক্কার কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এটিই বিশ্বের প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি, যা ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে বিখ্যাত।
অষ্টম হিজরি; বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা পঙ্কিলতামুক্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি। বিশ্বনবী নীরবে সে আয়োজন করলেন। এ জন্য পবিত্র মক্কা জয় করতে হবে। তবে ‘তিনি ধ্বংসাত্মক বিজয় চান না, তিনি কুরাইশদের রক্ষা করতে চান। তিনি চান প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে। অষ্টম হিজরির রমজান মাসে মক্কা বিজয় হয় এবং নবীজি (সা.) ওমরাহ সম্পাদন করেন। দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় সোয়া লাখ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে হজ সম্পাদন করেন। এই হজই নবীজি (সা.)-এর জীবনে একমাত্র হজ; এটিই প্রথম হজ ও শেষ হজ। এর ৮৩ দিন পর ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন; এই কারণে এই হজ ইতিহাসে বিদায় হজ নামে প্রসিদ্ধ। (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা)।
বিদায় হজের ভাষণ
বিদায় হজে প্রিয় নবীজি (সা.) উপস্থিত সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। এটি ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক ভাষণ, যা তিনি দশম হিজরি সনের নবম জিলহজ আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে ও জাবালে রহমতের ওপরে এবং পরদিন দশম জিলহজ ঈদ ও কোরবানির দিন মিনাতে প্রদান করেছিলেন। (সিরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৭৩-২৭৭)।
নবীজি (সা.) তাঁর ভাষণে বলেন: হে লোক সকল! আল্লাহু তাআলা বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার(কুরআন সুন্নাহ ও কুরআন- সুন্নাহ, তাওরাত ও ইঞ্জিল মাহ্জাব ও মানহাজ )।’ (সুরা ৪৯, হুজুরাত, আয়াত ১৩)। অতএব শুনে রেখো মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার(প্রজ্ঞা, জ্ঞান, ধার্মিকতা, যোগ্যতা, উদারতা, মানবিকতা, দক্ষতা) ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসীদের) প্রতি খেয়াল রাখবে(ধর্মীয় ভাবে অমুসলিমদের উপর ধর্ম প্রচার প্রশিক্ষণসহ দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতাও বিদ্যমান যদিও বর্তমানে মুসলিমদের বিশ্ব আর্থিক সম্পদের দায়িত্ব নেই কারণ গোটা পৃথিবী মুসলিম ও আহলে কিতাবীদের যৌথ নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে যা জাতিসংঘের উপরই দায়িত্ব), তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকেও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে(প্রত্যেক মানুষ একে অপরের ভাইবোন)
ও ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য উম্মত কাফেরদের জন্য নবীজির দোয়া ও আহ্ববান হে আল্লাহ, তাদের ক্ষমা করো, জ্ঞান দাও, হেদায়েত কর। তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে(কুরআন সুন্নাহ ও কুরআন- সুন্নাহ, তাওরাত ও ইঞ্জিল মাহ্জাব ও আকিদা মানহাজ ); পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্ট চিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
মানবতার ঐতিহাসিক দলিল বিদায় হজের ভাষণ
হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব না। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের নিকট অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সকল প্রকার সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। সাবধান! জাহেলি যুগের সব ব্যাপার (অপসংস্কৃতি) আমার উভয় পায়ের নিচে। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও বাতিল হলো।জাহিলি যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি রবিয়া ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির (র.), খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক প্রাপকের জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারও জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়; যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্ট চিত্তে প্রদান না করে। কোনো মহিলার জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থসম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে। ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান, ধন এবং প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে। হে মানুষ!
বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয।শুনে রেখো। একজন কুশ্রী-কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনীত হয়, যদ্দিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, তদ্দিন তার আনুগত্য করা তোমাদের ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।
অতএব হে মানবজাতি! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি।শুনে রেখো। আমার পর আর কোনও নবী নেই(অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহর যুগোপযোগী প্রয়োজনীয় সংস্কার ব্যতীত নতুন কোনো আসমানী কিতাব নেই, ঈসা আঃ ও কুরআন সুন্নাহর উপর আসবেন ও গোটা মানবজাতির নেতৃত্ব দিবেন )। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (স.)-এর সুন্নাহ। আমি তোমাদের মাঝে জিনিস রেখে গেলাম, আল্লাহর কিতাব এবং আমার (নবী স. এর) ইতরাত (আহলে বাইত) (নবীজির ঈমানদার যোগ্য বংশধর ও উত্তরাধিকারীগণ এবং তার শিক্ষা ও কিতাব গ্রহণকারীগণ)।হে মানুষ!
প্রত্যেককেই শেষবিচারের দিন সব কাজের হিসাব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও।
বিদায় হজযাত্রায় মহানবী (সা.)–র রাগের পেছনে
প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সকলে শোনো! এখানে উপস্থিতগণ যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের(মুসলিম, অমুসলিম, আহলে কিতাবসমূহ) নিকট পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।
অতঃপর নাজিল হয়, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম; এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম।’ (আল–কোরআন, পারা ৬, সুরা ৫, মায়িদাহ, আয়াত ৩)।
উল্লেখ্য, হজ্ সবচেয়ে বড় ইবাদত উৎসব যেখানে মানুষ সর্বশক্তিমান এক আল্লাহ ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত, কুরবানী, ঈদ, আকীকা, ঐক্য(বিশ্ব রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক), হালাল হারাম, নারীপুরুষ সুশৃক্ষলতা সামাজিকতা, আবিষ্কার অনুসন্ধানী ভ্রমণ, বিনোদন, কেনাকাটা ব্যবসা বাণিজ্য, সৎকর্ম একত্রে হয়ে থাকে।
বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহতা, স্বজনপ্রীতির বিরূপ প্রভাব, জাহেলি যুগের মানসিকতা পরিহার করার বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেছেন। নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেছেন। সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভারসাম্য নীতি, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পরমতসহিষ্ণু হওয়া, সর্বোপরি মানব সভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা পরিহার করে একনিষ্ঠভাবে কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মুহাম্মদের(সা.) এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্ত্যের সকল কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিলো এবং মানুষকে এসবকিছুর আমানতদার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিলো।মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেয়া হয়েছিলো। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব এবং বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো। ভাষণে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে উম্মাহর ঐক্যের বিষয়টি।এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিলো। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিলো না, বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও এতে ছিলো। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের সাহ্ম্য, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই এই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিলো ।
সংকলিত মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী থেকে : যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
No comments:
Post a Comment